কুয়েত তার প্রতিবেশী সৌদি এবং আমিরাতের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেছে, যাদের সঙ্গে ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি রয়েছে।
ড. প্রসান্ত কুমার প্রধান: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক কুয়েত সফর ভারত-কুয়েত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের বৃহত্তর সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করেছে। দীর্ঘ ৪৩ বছর পর কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এই দেশে সফর করলেন।
মোদীর সফরে তিনি কুয়েতের আমির শেখ মেশাল আল আহমদ আল জাবের আল সাবাহ এবং যুবরাজ শেখ সাবাহ আল খালেদ আল হামাদ আল মোবারক আল সাবাহসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে উভয় দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং সম্পর্ক আরও মজবুত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
মোদীর কুয়েত সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সম্পর্ককে কৌশলগত স্তরে উন্নীত করার ঘোষণা। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। কুয়েত এভাবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্বের তালিকায় যুক্ত হলো।
দ্বিপাক্ষিক চুক্তি
সফরের সময় ভারত ও কুয়েতের মধ্যে একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক উল্লেখযোগ্য। এই চুক্তি উভয় দেশের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও জোরদার করবে।
সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবিলা উভয় দেশের জন্যই একটি সাধারণ উদ্বেগ। বৈঠকের সময় উভয় পক্ষ নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করা, তথ্য ও গোয়েন্দা বিনিময় করা, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির বিষয়ে সম্মত হয়।
উভয় দেশ সন্ত্রাসীদের সাইবারস্পেস ব্যবহার রোধ করার বিষয়েও একমত হয়েছে।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
বর্তমানে ভারত ও কুয়েতের মধ্যে মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১০.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারত কুয়েতের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল থেকে আরও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চায়।
কুয়েতের বিনিয়োগ বর্তমানে মাত্র ৯৪.৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম। কুয়েতের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সার্বভৌম সম্পদ তহবিল।
কুয়েত ভারতীয় বাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মোদী কুয়েতি ইনভেস্টমেন্ট অথরিটিকে ভারত সফর করে বিনিয়োগের সুযোগগুলো পরীক্ষা করার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আরও গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা কুয়েতের ‘ভিশন ২০৩৫’ লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি তাদের অর্থনীতি বহুমুখীকরণ, একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, উন্নত অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং টেকসই জীবনধারার পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।
জ্বালানি সহযোগিতা
জ্বালানি ভারতের উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অন্যতম প্রধান উপাদান। ভারত তার মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আমদানি করে। ইরাক, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়াও কুয়েত ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ।
জ্বালানি ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত সহযোগিতার বাইরে গিয়ে ভারত নবায়নযোগ্য জ্বালানি, যেমন গ্রিন হাইড্রোজেন এবং বায়োফুয়েলের ক্ষেত্রে কুয়েতের সঙ্গে সহযোগিতা আরও গভীর করতে চায়।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহযোগিতায় একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে কুয়েত আন্তর্জাতিক সৌর জোটে সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতা তাদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্থায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে।
ভারতীয় প্রবাসী
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক ছাড়াও উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের সফট পাওয়ার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুয়েতে প্রায় ১০ লাখ ভারতীয় নাগরিক বসবাস করেন। তারা উভয় দেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করেছেন। কুয়েতে প্রবাসী ভারতীয়দের অবদান জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী কুয়েত সফরের সময় প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং তাদের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ভারত বিশ্বব্যাপী মানবসম্পদ সরবরাহে সক্ষম।
কুয়েতের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান
কুয়েতের আমির প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ‘দ্য অর্ডার অব মুবারক আল কাবির’ – কুয়েতের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ভারত-কুয়েত সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই সম্পর্ক সভ্যতা, সাগর এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে গভীর হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, দুই দেশই একে অপরকে সংকটময় মুহূর্তে সহায়তা করেছে।
উপসংহার
প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সফর উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছে।
উভয় দেশই কৌশলগত অংশীদারিত্বে নতুন আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের অস্থিতিশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতায় সম্পৃক্ত হওয়া উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থে কার্যকর।
ভারত তার সম্প্রসারিত প্রতিবেশী নীতির অধীনে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্বের দিকে মনোনিবেশ করছে, আর কুয়েত তার নিকট প্রতিবেশীর বাইরেও সম্পর্ক বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে।
উভয় দেশের স্বার্থের সুরক্ষা এবং সাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দৃঢ় সংকল্প তাদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করছে।
লেখক: ড. প্রসান্ত কুমার প্রধান, গবেষণা ফেলো এবং সমন্বয়কারী, পশ্চিম এশিয়া কেন্দ্র, মানোহর পার্রিকর প্রতিরক্ষা অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক।